ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মেরূকরণে নানামুখী উদ্যোগ ও তৎপরতা চলছে। সবচেয়ে বেশি তৎপরতা চলছে বিএনপি ও নবগঠিত এনসিপির (জাতীয় নাগরিক পার্টি) মধ্যে আসন ভাগাভাগি প্রশ্নে।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে বিএনপির সঙ্গে এনসিপি নেতাদের কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে কতটি আসন নিয়ে সমঝোতা করা যায় সেই বিষয়টি আলোচনায় উঠলেও সিদ্ধান্ত হয়নি। আলোচনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ের ও অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচন ঘনিয়ে এলে এ ধরনের সমঝোতার নিষ্পত্তি হবে।
তবে ওই আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, আলোচনা সফল হলে এনসিপিসহ হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে জড়িত থাকা অন্যান্য দলকে সবমিলিয়ে ৫০টি আসন ছাড় দিতে পারে বিএনপি। এর মধ্যে ছাত্রদের নতুন দল এনসিপিকে সর্বোচ্চ আসনে ছাড় দেওয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে। এনসিপির সঙ্গে ২০ থেকে ৩০ আসনে সমঝোতার বিষয়টি মাথায় রেখেই এগোচ্ছে ওই সমঝোতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর নেতারা। এ ছাড়া বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপি, ১২-দলীয় জোট, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ অন্য দলগুলোকে ১৫ থেকে ২০টি আসনে ছাড় দেওয়া হতে পারে। এসব দল আওয়ামী বিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে এককাট্টা ছিল। এ বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য সরাসরি তদারকি করছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘জোট বা আসন ছাড়ের কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। এই বিষয়ে দলের ভেতরে চূড়ান্ত কোনো আলোচনা এখনো হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচনে অনেক কিছুই হয়, সেটা দেখতে হবে। তবে ছাত্রদের সঙ্গে চূড়ান্ত কোনো আলাপ-আলোচনা আমাদের হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনে যেসব দল ছিল, তাদের সঙ্গে আমরা জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করব, এটা দলীয়ভাবে নীতিগত সিদ্ধান্ত। তবে কারা করবে, কীভাবে করবে তা পরিষ্কার হতে আরও সময় লাগবে। নির্বাচনের পর ঐকমত্যের জাতীয় সরকার গঠন করবে বিএনপি। জনগণ যদি আমাদের ম্যান্ডেট দেয়, তাহলে আমরা রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা বাস্তবায়ন করব।’
নির্ভরযোগ্য সূত্র আরও জানায়, বিএনপির সঙ্গে নানা ইস্যুতে সরকার ও জামায়াতের ইসলামীর সঙ্গে দূরত্বের কারণে উভয় দলের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত কয়েকটি দলের নেতারা তিন পক্ষকেই সমঝোতা করার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলছেন, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র নেতাদের সঙ্গে বিএনপির সমঝোতা হলে সবদিক সামাল দেওয়া সহজ হবে। পাশাপাশি বিএনপিকে নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে থাকা অস্থিরতাও কমবে। ওই শুভাকাঙ্ক্ষীরা মনে করেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও সরকার চালাতে ছাত্রসমাজসহ অন্যান্য দলের সহায়তা প্রয়োজন হবে। কারণ তা না হলে আওয়ামী লীগ ছাড়াও নানা ইস্যুতে চাপ সামাল দিতে হবে ছাত্রসমাজ ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলকে। বিএনপির একার পক্ষে চতুর্মুখী চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হবে বলে তারা মনে করছেন। ফলে সবদিক সামাল দিতে এনসিপির সঙ্গে সমঝোতা করা সুবিধাজনক বলে মনে করছে বিএনপি ও ছাত্রদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা। ওই শুভাকাঙ্ক্ষীরাই সমঝোতা প্রশ্নে মধ্যস্থতা করছেন বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে বিএনপিকে ক্ষুব্ধ করেও এনসিপি বা অন্তর্বর্তী সরকারেরও সব সিদ্ধান্ত নেওয়া ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ফলে তাদেরও বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করেই চলতে হবে। এই তিন শক্তির মধ্যে বিরোধ বেশি দানা বাঁধলে তৃতীয় পক্ষ বা আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে সুযোগ পাবে বলে তাদের মধ্যে আলোচনা আছে। এ ছাড়া এনসিপি রাজনীতিতে নেমেই ভালো ফলাফল করতে পারবে কি না, তা নিয়েও রাজনীতিকদের মাঝে নানা আলোচনা আছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, সেদিক থেকেও তিন পক্ষের মধ্যে সমঝোতাই সবদিক সামাল দেওয়ার সবচেয়ে ভালো কৌশল বলে মনে করা হচ্ছে।
বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, ফ্যাসিবাদী বিরোধী আন্দোলনে যারা ছিল তাদের সঙ্গে নিয়ে ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ গঠন করার ভাবনা রয়েছে তাদের। তবে ওই সরকারে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব থাকার বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। কারণ, ৩১ দফা প্রণয়নকালে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল ছিল না। ফলে জাতীয় সরকারের কাঠামো কী হবে, নির্বাচনের পরেই বোঝা যাবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ছাত্রদের সঙ্গে আসন সমঝোতা বা জোট গঠনের বিষয়ে স্থায়ী কমিটিতে কোনো আলাপ-আলোচনা এখনো হয়নি। ফলে কোনো কিছু বলার মতো সময় হয়নি।
বিএনপির সূত্রমতে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ইতোমধ্যে ৬ নেতাকে আসনভিত্তিক চিঠি দেওয়া হয়েছে। এরা মধ্যে লক্ষ্মীপুর থেকে একটি আসনের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রবকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে। তবে সেটি কোন আসনে তা স্পষ্ট নয়। কারণ লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য আশরাফ উদ্দিন নিজান। ফলে তাকে বঞ্চিত করে রব দাবি করলেও ওই আসন ছেড়ে দেওয়া বিএনপির জন্য কঠিন। এ ছাড়া বগুড়া-২ আসনের নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা-১২ আসনের গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী, পটুয়াখালী-৩ আসনের গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর, ঝিনাইদহ-২ আসনের গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান এবং কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠির অনুলিপি সংশ্লিষ্ট জেলার শীর্ষ নেতাদের দিয়ে তাদের সার্বিক সহযোগিতা করার নির্দেশ দেয় বিএনপি। তবে এটি আসন চূড়ান্তের কোনো চিঠি নয় বলে জানিয়েছেন বিএনপির হাইকমান্ড।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, নির্বাচনে এ সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া যায় কি না, এই বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। কতটা আসন ছাড় দেওয়া যেতে পারে সে ব্যাপারেও প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে।
এদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজের সঙ্গে বিএনপির সমঝোতায় বেশ কয়েকজন উপদেষ্টার সায় রয়েছে। কারণ বিএনপি ও ছাত্রদের সঙ্গে সমঝোতা হলে সরকারের ওপর থাকা বিদ্যমান চাপও অনেকটাই কমে যাবে। এতে সরকারও স্বস্তি পাবে। প্রায় মাস খানেক আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তার বাসায় বৈঠক করেছেন এনসিপির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী। বৈঠকে তারা বিএনপির কাছে শতাধিক আসনে ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করেন। এ ছাড়া গত ১৭ ফেব্রুয়ারি দলের ঘোষণার আগেও বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ দুই নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন এনসিপির শীর্ষ নেতারা।
সূত্র জানায়, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির জোট করার চিন্তা নেই। অপরদিকে জামায়াতের সঙ্গেও এনসিপি নির্বাচনে কোনো জোট করবে না। দলের বড় একটি অংশ জামায়াতের সঙ্গে জোট করতে অনাগ্রহী। তারা বিএনপি বা যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনাদের সঙ্গে আসন সমঝোতা করতে চায়। এনসিপি নেতারা মনে করেন, এর আগে সারা বিশ্বে ‘জামায়াত-বিএনপি’, ‘বিএনপি-শিবির’ বলে ব্র্যাকেন্টবন্দি বা ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে। সেই পুরোনো ট্যাগ বা ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হতে চায় না এনসিপি। যদিও জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে ছাত্রদের সম্পর্ক খুব একটা খারাপ নয়।
এনসিপি নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, দলটি এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। তবে কোনো জোটে যাবে কি না এনসিপি, তা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে সারা দেশে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার চিন্তা রয়েছে তাদের। ঈদের পরেই মহানগর ও জেলা সমাবেশ কর্মসূচি নিয়ে নামার পরিকল্পনা রয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন একাত্তর সংবাদকে বলেন, ‘দলের ভেতরের জোট বা আসন সমঝোতা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। নির্বাচনি জোট হবে কি না, তা নির্বাচনের আগ মুহূর্তে রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি দেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরা আপাতত দল গঠনের দিকেই বেশি জোর দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলেছি। সেখানে সব রাজনৈতিক দলই অংশগ্রহণ করবে। ৩০০ আসনের প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছি। আবার আসন বাড়িয়ে ৫০০ করার কথা আলোচনায় এসেছে।’
এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীন শিশির বলেন, বিএনপি কিংবা অন্য দলের সঙ্গে আসন সমঝোতার কোনো আলাপ-আলোচনা এখনো আমাদের পার্টিতে হয়নি। দল ঘোষণার পর আমরা আপাতত দল গোছানোসহ প্রাথমিক কাজের দিকে মনোযোগ দিয়েছি।