
খুনের রহস্য ছাপিয়ে স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের গল্প, ‘রেখাচিত্রম’ নিয়ে এক লাইনে এভাবেই বলা যায়। আলোচনা যে হচ্ছে মালয়ালম থ্রিলার সিনেমা ‘রেখাচিত্রম’ নিয়ে অনেক পাঠকের এর মধ্যেই তা বুঝে যাওয়ার কথা। কারণ, গত সপ্তাহে ওটিটিতে মুক্তির পর অনেক দেশি দর্শকও মজেছেন এই দক্ষিণি সিনেমায়।
একনজরে
- সিনেমা: ‘রেখাচিত্রম’
- ধরন: ক্রাইম থ্রিলার
- অভিনয়: আসিফ আলী, অনস্বরা রাজন ও মনোজ কে জায়ান
- পরিচালনা: জোফিন টি চাকো
- দৈর্ঘ্য: ১৪০ মিনিট
- স্ট্রিমিং: সনি লিভ
অনলাইনে জুয়া খেলার দায়ে পুলিশ কর্মকর্তা বিবেক সাসপেন্ড হন। বহিষ্কারাদেশ কাটিয়ে চাকরিতে যোগদানের পর তাঁকে বদলি করা হয় এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। প্রথম দিনেই এক অভাবনীয় ঘটনার মুখোমুখি হন বিবেক। সেখানকার জঙ্গলে ফেসবুক লাইভে এসে এক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেন। তবে নিজেকে গুলি করার আগে তিনি বলে যান, চার দশক আগের এক খুনের কথা। বলে যান সেই তরুণীকে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে এ জঙ্গলেই। তাঁর সঙ্গে এই কাজে যুক্ত ছিলেন এমন কয়েকজনের নামও বলে যান। যার মধ্যে একজন এখন খুবই প্রভাবশালী অলংকার ব্যবসায়ী। বিবেক নেমে পড়েন তদন্তে, খোঁড়াখুঁড়ির পর পাওয়া যায় কঙ্কাল। অনেক খোঁজখবরের পর জানা যায়, কঙ্কালটি রেখা নামের এক তরুণীর। কিন্তু কে এই তরুণী? তদন্তে নেমে একের পর এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন বিবেক। মোটা দাগে এই হলো সিনেমার গল্প।
গত কয়েক গত বছরে একের পর এক থ্রিলার বানিয়ে চমকে দিয়েছে মালয়ালম সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি। বেশির ভাগ ছিল খুবই কম বাজেটে নির্মিত। কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত চিত্রনাট্য, নির্মাণ আর অভিনয়ের গুণে সিনেমাগুলো দর্শক ও চলচ্চিত্র সমালোচকদের নজর কেড়েছে। ‘রেখাচিত্রম’ও তেমনি। মাত্র ছয় কোটি রুপি বাজেটের সিনেমাটি বক্স অফিসে প্রায় ৬০ কোটি রুপি ব্যবসা করেছে!
তবে ‘রেখাচিত্রম’ অন্য মালয়ালম থ্রিলারের চেয়ে খানিকটা আলাদা, এখানে রোমাঞ্চকর গল্পের সঙ্গে মূলত আশির দশকের মালয়ালম সিনেমাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছেন নির্মাতা জোফিন টি চাকো। এটিকে তাই মালয়ালম সিনেমার প্রতি ‘ভালোবাসার চিঠি’ বললেও ভুল হবে না।
সিনেমায় দেখা যায়, রেখা ছিলেন চলচ্চিত্রে এক্সট্রা অভিনেত্রী। আদতে তিনি ছিলেন সিনেমার পোকা। ঘরভর্তি থাকত তারকাদের কাটআউটে, চিঠি লিখতেন বড় তারকাদের। পাঁড় ভক্ত ছিলেন মালয়ালম তারকা মামুত্তির। ঘটনাচক্রে এক্সট্রা অভিনেত্রী হিসেবে যে সিনেমায় রেখা অভিনয়ের সুযোগ পান, সে সিনেমার নায়ক ছিলেন মামুত্তি। রেখার খুশি আর দেখে কে! সে স্বপ্ন দেখতে একদিন বড় অভিনেত্রী হবে কিন্তু লাশ হয়ে জঙ্গলে চাপা পড়ে তাঁর সে স্বপ্ন।
‘রেখাচিত্রম’ মার্ডার মিস্ট্রি হলেও আদতে সিনেমা-পাগল এক তরুণীর স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের গল্প। সিনেমা যত এগিয়ে যায়, বিবেক খুনের রহস্যের সঙ্গে রেখার জীবন নিয়েও আগ্রহী হয়ে ওঠে। তদন্তকারী অফিসারকে মারার ক্লিশে চেষ্টা, দুর্বল খলনায়ক থাকার পরও তাই ‘রেখাচিত্রম’ মুগ্ধ করে।
সিনেমাটির আরেকটি শক্তিশালী দিক অভিনয়। পুলিশ কর্মকর্তা বিবেক চরিত্রে আবারও দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন আসিফ আলী। গত বছরের শেষে মুক্তি পাওয়া আরেকটি আলোচিত থ্রিলার সিনেমা ‘কিসকিন্দা কান্দাম’-এও প্রধান চরিত্রে ছিলেন তিনি। এ সিনেমা দিয়ে যেন আরেক পারফরম্যান্সকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। অনলাইন জুয়া খেলার দায়ে বরখাস্ত পুলিশ অফিসার থেকে ব্যক্তি বিবেকের জীবনে যে পরিবর্তন হয়, সেটা তিনি পর্দায় তুলে ধরেছেন খুবই বিশ্বাসযোগ্যভাবে।
স্বল্প উপস্থিতি হলেও রেখা চরিত্রে মুগ্ধ করেছেন অনস্বরা রাজন। তাঁর চাহনি, কথা বলা, হাসি এতটাই সাবলীল; মনে হচ্ছিল সত্যি সত্যিই আশির দশক থেকে উঠে আসা কোনো চরিত্র।
আরেকজনের কথা না বললে ‘রেখাচিত্রম’-এর আলোচনা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে, তিনি অতি অবশ্যই মামুত্তি। আশির দশকে মালয়ালম সিনেমার পোস্টার বয় হিসেবে এ সিনেমায় তাঁকে দারুণভাবে ব্যবহার করেছেন নির্মাতা। সব দৃশ্যে তাঁকে সরাসরি ক্যামেরায় দেখানো হয়নি, কিন্তু সেসব দৃশ্যেও তিনি যেন আরও প্রবলভাবে হাজির। সিনেমায় মামুত্তি নিজে অভিনয় করেননি, পর্দায় তাঁকে বাস্তব করা হয়েছে এ আই প্রযুক্ত ব্যবহার করে।
আশির দশকের চলচ্চিত্র সাংবাদিকের চরিত্রে টি জি রবিও দারুণ। সাংবাদিক চরিত্রটি আজকাল অবশ্য ইউটিউব কনটেন্ট বানান। নিজেই বলেন, ভিডিওতে বাস্তব চরিত্রের সঙ্গে বানানো গল্প জুড়ে দেন; চরিত্রটি দিয়ে আজকালকার ইউটিউবারদেরও একটা বার্তা দিয়েছেন নির্মাতা। কেবল টি জি রবিই নন, পার্শ্বচরিত্রে মনোজ কে জায়ান, সিদ্দিকিও বেশ ভালো।
‘রেখাচরিত্রম’ জোফিন টি চাকোর দ্বিতীয় সিনেমা। ২০২১ সালে তিনি মামুত্তিকে নিয়ে বানিয়েছিলেন ‘দ্য প্রিস্ট’। পরপর দুটি ব্যবসাসফল থ্রিলার উপহার দিলেন এই তরুণ নির্মাতা।
ওটিটিতে ফি সপ্তাহেই এন্তার থ্রিলার মুক্তি পায়, যার অনেকগুলোই চর্বিত চর্বণ। তবে আশির দশকের মালয়ালম সিনেমা, এক তরুণীর স্বপ্নভঙ্গের সঙ্গে যে বুদ্ধিদীপ্ত মার্ডার মিস্ট্রি বানিয়েছেন চাকো, সে জন্য তাঁর তারিফ করতেই হয়।